সুন্দরবন (SUNDARBAN) বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন

 




সুন্দরবনের পরিচিতি :

সুন্দরবন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় বিস্তৃত এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অংশ জুড়ে রয়েছে। সুন্দরবন শুধুমাত্র একটি বনাঞ্চল নয়; এটি প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়, যা জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এবং পরিবেশগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হওয়ায় এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।

সুন্দরবনের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার অবস্থিত। এটি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর মোহনায় গঠিত হয়েছে এবং অসংখ্য ছোট ছোট নদী, খাল ও উপকূলীয় দ্বীপ নিয়ে গঠিত।

জীববৈচিত্র্য

সুন্দরবন তার বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগতের জন্য বিখ্যাত।

রাজকীয় বেঙ্গল টাইগার

সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ হলো রাজকীয় বেঙ্গল টাইগার (Panthera tigris tigris)। বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, তবে সুন্দরবন এখনও এই মহিমান্বিত প্রাণীর আশ্রয়স্থল।

অন্যান্য বন্যপ্রাণী

সুন্দরবনে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • হরিণ: বিশেষ করে চিত্রল হরিণ বা চিতল হরিণ

  • কুমির: লবণাক্ত পানির কুমির (Saltwater Crocodile)

  • সাপ: বিভিন্ন বিষধর ও অবিষধর সাপ

  • বন্য শুকর: যারা সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে

পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণী

সুন্দরবনে প্রায় ৩১৫ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়, যার মধ্যে মাছরাঙা, শকুন, বক ও পানকৌড়ি অন্যতম। এছাড়া অসংখ্য মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ এবং ডলফিনও এই অঞ্চলে বসবাস করে।

গাছপালা ও উদ্ভিদ

সুন্দরবনের গাছপালা এই অঞ্চলের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • গরান গাছ (Rhizophora)

  • সুন্দরি গাছ (Heritiera fomes) – এই গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ

  • গেওয়া গাছ (Excoecaria agallocha)

সুন্দরবনের গুরুত্ব

পরিবেশগত গুরুত্ব

সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি প্রাকৃতিক বাঁধ হিসেবে কাজ করে এবং উপকূলীয় এলাকা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে। এছাড়া এটি কার্বন শোষণের মাধ্যমে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাতে সাহায্য করে।

অর্থনৈতিক ও পর্যটন গুরুত্ব

সুন্দরবন থেকে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, বিশেষ করে মধু সংগ্রহকারী, কাঠ কাটার শ্রমিক ও জেলে সম্প্রদায়। এছাড়া সুন্দরবন পর্যটনের জন্য একটি অন্যতম গন্তব্য, যেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন বাঘ, হরিণ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

সুন্দরবনের চ্যালেঞ্জ ও বিপদ

বন নিধন ও অবৈধ শিকার

মানবসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের আয়তন দিন দিন কমছে। অবৈধ বন নিধন, বাঘ ও হরিণ শিকার এবং দস্যুদের দৌরাত্ম্য সুন্দরবনের জন্য বড় হুমকি।

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

সুন্দরবন নিয়মিত সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার সমস্যার সম্মুখীন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের অনেক অঞ্চল ইতিমধ্যেই বিপদগ্রস্ত।

সংরক্ষণ প্রচেষ্টা

বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুন্দরবন রক্ষায় কাজ করছে। আইইউসিএন ও ইউনেস্কোর মতো সংস্থা সুন্দরবন সংরক্ষণে গবেষণা করছে। বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করেছে, যেখানে বন সংরক্ষণের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

উপসংহার

সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, এটি বিশ্বের একটি অমূল্য সম্পদ। এর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভূমিকা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি একে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্যই এটি একটি বড় ক্ষতি হবে। তাই আমাদের সকলের উচিত সুন্দরবন সংরক্ষণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা এবং এর অপরিসীম সৌন্দর্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা।

Comments